শরীরের ভাল ব্যাকটেরিয়া আর খারাপ ব্যাকটেরিয়া- এ সম্পর্কে জানেন কি?

ভাল ব্যাকটেরিয়া আর খারাপ ব্যাকটেরিয়া

আমাদের শরীরে কোটি কোটি রোগ-সৃষ্টিকারী অনুজীব বা প্যাথোজেন (Pathogen) বসবাস করে। এরা হল- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া, ছত্রাক ইত্যাদি। বলা যায়, আমাদের দেহের ভিতরেই এরা ঘর-সংসার পেতে বসেছে। এখানেই এরা জীবিত থাকে, পুষ্টি পায়, মারা যায় এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করে। এরা প্রধানত আমাদের দেহে রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
যাই হোক, আমরা এখানে ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) নিয়ে ফোকাস করব। ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহে যক্ষ্মা, কলেরা, আমাশয়, মেনিনজাইটিস, নিউমোনিয়া, প্লেগ, টাইফয়েড, গণোরিয়া প্রভৃতি রোগ সংক্রমনের জন্য দায়ী। আমরা যে বিভিন্ন অসুখে এন্টিবায়োটিক ওষুধ খেয়ে থাকি, তা ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ থেকে বাঁচার জন্যই।

ব্যাকটেরিয়া কি?

এই যে আমরা প্রায়শই ব্যাক্টেরিয়ার কথা শুনে থাকি এবং জানি যে এটা রোগ সৃষ্টি করে- সেই ‘ব্যাকটেরিয়া’ জিনিসটি কি? এটা কি কোন প্রাণি না পদার্থ? ব্যাকটেরিয়া দেখতে কেমন?

ব্যাকটেরিয়া হল এক অতি ক্ষুদ্র অনুজীব যা অনুবীক্ষন যন্ত্র ছাড়া দেখা যায়না। এরা বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে; যেমন- গোলাকার ,ত্রিভুজাকার, লম্ববাকর ইত্যাদি। এর পূর্বে একটি পোস্টে আমরা কোষ নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের দেহ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন কোষ দ্বারা গঠিত। বলা হয়ে থাকে, আমাদের দেহে যত কোষ আছে তার চেয়ে বেশি আছে ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য রোগ সৃষ্টিকারী অনুজীব। ব্যাকটেরিয়া যেমন রোগ সৃষ্টি করে, তেমনি আমাদের দেহে এর উপকারী ভূমিকাও রয়েছে। ব্যাকটেরিয়া দ্বিবিভাজন পদ্ধতিতে বংশবিস্তার করে, অর্থাৎ একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি হয়ে যায়।

এবার আমরা দুএকটি প্রশ্নের মিমাংসা করে নিই-

প্রশ্নঃ ব্যাক্টেরিয়া আমাদের দেহের কোথায় থাকে?

উত্তরঃ ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহের সব জায়গায় থাকে- কোষে, ত্বকে, ত্বকের বাইরে, শ্বাসনালীতে, ব্রেইনে। সবচেয়ে বেশি থাকে আমাদের অন্ত্রে; অর্থাৎ পাকস্থলি বা পেটে। আমাদের দেহের প্রায় ৮৫% রোগ হয় পেট থেকে। আর এই রোগ সংক্রমনের ক্ষেত্রে অন্ত্রে থাকা ব্যাক্টেরিয়ার রয়েছে বিরাট ভূমিকা।

প্রশ্নঃ ব্যাকটেরিয়া কিভাবে দেহে রোগ সৃষ্টি করে?

উত্তরঃ ব্যাকটেরিয়া কখনও কখনও এত দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি করে যে তারা কোষ ও অঙ্গের স্বাভাবিক কাজকে ব্যাহত করে। কখনও কখনও তারা সরাসরি কোষ এবং টিস্যুকে মেরে ফেলে। কখনও কখনও তারা বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করে যা পক্ষাঘাতগ্রস্ত করতে পারে এবং কোষের বিপাকীয় যন্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে। মানুষ ও প্রাণির দেহে রয়েছে শত শত প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া। এরা বিভিন্ন উপায়ে দেহে ভিন্ন ভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।

ভাল ব্যাকটেরিয়া বনাম খারাপ ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া নামটি শুনলেই আমাদের মনে একটা ভীতির ভাব চলে আসে। একে দেহের জন্য ক্ষতিকর একটা কিছু বলেই মনে হয়। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া মানেই কিন্তু খারাপ কিছু নয়। আমাদের দেহে আছে ভাল ব্যাকটেরিয়া এবং খারাপ ব্যাকটেরিয়া। আপনারা কি টক দই খান? দুধ থেকে যে টক স্বাদের দই হয়, তা কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়ার কারনেই। এরা হল উপকারী ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া সহই আমরা দই খাই আর এতে পেটের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

আমরা এখানে ব্যাকটেরিয়ার কারনে প্রভাবিত পেটের স্বাস্থ্য সম্পর্কেই কথা বলব।

চলুন তাহলে, ভাল ব্যাকটেরিয়া ও খারাপ ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিই-

  • ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলো সাধারণত আমাদের দেহের ভিতরেই তৈরি হয়, আর ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বাইরের পরিবেশ থেকে এসে আমাদের দেহকে সংক্রমিত করে।
  • ভাল ব্যাকটেরিয়া গ্রু করে এমন খাদ্য বা সাপ্লিমেন্ট গ্রহনের মাধ্যমেও ভাল ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করা যায়। এদেরকে বলে প্রোবায়োটিক (Probiotic)।
  • ভাল ব্যাকটেরিয়া খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে ধংস করতে সাহায্য করে এবং আমাদের পেটের পরিবেশকে সুস্থ্য ও শক্তিশালী রাখে।
  • ভাল ব্যাকটেরিয়া এসিড ও টক্সিন তৈরি করে অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ও অনুজীব বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ফলে হযম শক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। গ্যাস্ট্রিক ও আইবিএস (IBS) এর মত প্রতিরোধ করে, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
  • পেটের সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য সব সময় ভাল ব্যাকটেরিয়া ও খারাপ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে।
  • খারাপ ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গেলে এমনকি ভাল ব্যাকটেরিয়াকেও মেরে ফেলে এবং সংক্রামক রোগের বিস্তার ঘটায়।
  • রোগ সারানোর জন্য এন্টিবায়োটিক দিয়ে খারাপ ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে ফেললে সাথে ভাল ব্যাকটেরিয়াও মারা যায়, যা পেটের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর।
  • প্রোবায়োটিকের মাধ্যমে পেটের ভিতরে ভাল ব্যাকটেরিয়া চাষ করে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রভাবশালী (Dominant) রাখলে অনেক অনেক সংক্রামক ও লাইফস্টাইলজনিত রোগ থেকে বাঁচা যায়।

কিভাবে পেটে ভাল ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করা যায়?

ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির সহ অনেক ডাক্তারই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধকে নিরুৎসাহিত করেন। কারন, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেলে খারাপ ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি ভাল ব্যাকটেরিয়াও নষ্ট হয়ে যায়। তার পরিবর্তে প্রিবায়োটিক ও প্রবায়োটিক প্রেসক্রাইব করেন। যাই হোক, পেটে ভাল ব্যাকটেরিয়া চাষ ও বৃদ্ধি করা যায় দুটি উপায়ে; খাবারের মাধ্যমে ও সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে।

খাবারের মাধ্যমে

কিছু কিছু খাবার আছে যার মাধ্যমে ভাল ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করা যায়। যেমন- দই, কলা, ইয়োগার্ট, আপেল সিডার ভিনেগার, রসুন, আঁশযুক্ত খাবার; যেমন- উটস্‌, চিয়াসিড, ছোলা, ব্রকলি, মটরশুটি ইত্যাদি। এগুলোকে বলা হয় প্রোবায়োটিক বা প্রিবায়োটিক।

সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে

সাপ্লিমেন্ট হলো এমন কিছু পুষ্টি উপাদান যা খাদ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য এবং খাদ্যের পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করার জন্য খাদ্যে বাইরে থেকে যোগ করা হয় অথবা শরীরের পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করার জন্য মেডিসিন রুপে গ্রহণ করা হয়। সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায় ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা সিরাপ আকারে কিন্তু এটা রোগ নিরাময়কারী ওষুধ নয়। বিভিন্ন ধরনের প্রোবায়োটিক ও প্রিবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট রোগীর চাহিদা অনুসারে পাওয়ার নির্ধারন করে ডাক্তাররা প্রেসক্রাইব করে থাকেন।

প্রোবায়োটিক:  প্রোবায়োটিক পরিপাকতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। এটি হজমে সাহায্য করে এবং প্যাথোজেন থেকে দেহকে রক্ষা করে। প্রোবায়োটিক আমাদের দেহের বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান নিষ্ক্রিয় করে বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলস-এর যোগান দেয়। প্রোবায়োটিক হতে পারে খাবার বা সাপ্লিমেন্ট। প্রোবায়োটিক সাপ্লিমেন্ট আসলে জীবন্ত অনুজীব বা ব্যাকটেরিয়া যা ভাল ব্যাকটেরিয়ার জোগান দেয় এবং বংশ বিস্তারে সাহায্য করে।

প্রিবায়োটিক:  প্রিবায়োটিক হল উন্নত খাদ্য বা সাপ্লিমেন্ট যা অন্ত্রের ভাল ব্যাকটেরিয়াগুলির কার্যকলাপ এবং বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করার জন্য অত্যাবশ্যক। প্রিবায়োটিক ভাল ব্যাকটেরিয়ার জোগান দেয়না কিন্তু বংশ বিস্তারে সাহায্য করে।

প্রিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিকগুলি গ্যাস্ট্রিক, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (IBS), ডায়রিয়া, অ্যালার্জি সংক্রমণ এবং এমনকি সাধারণ সর্দির মতো অবস্থার চিকিত্সা করতে পারে।

মন্তব্য করুন