
অ্যালকালাইন ও এসিডিক – কথা দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য প্রত্যেকেরই এ দুটি টার্ম শিখে নেওয়া জরুরী
আমরা জানি এসিড ও ক্ষার বা অ্যালকালি পরস্পর বিপরীত ধর্মী দুটি জিনিস। এসিড হল টক স্বাদযুক্ত ক্ষয়কারী একটি পদার্থ। পক্ষান্তরে ক্ষার হল তিক্ত বা কটু স্বাদের সাবানের মত পিচ্ছিল একটি পদার্থ যার কোন ক্ষয়কারী ধর্ম নেই।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের যা জেনে রাখতে হবে তা হল এসিড ও ক্ষার পরস্পর বিপরীত। একটি অন্যটিকে প্রশমিত করে দেয়। যেমন পানি নিভিয়ে দেয় আগুনকে।
এসিড ও ক্ষার একত্রে মিশালে লবন ও পানি উৎপন্ন হয়। কোনোটিরই আর আলাদা অস্তিত্ব থাকে না।
মাটি, পানি, খাবার, রক্ত, মানবদেহ ইত্যাদি এসিডিক না ক্ষারীয় (অ্যালকালাইন) অর্থাৎ এসিডের প্রভাব বেশি না ক্ষারের ভাগ বেশি তা জানাটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
জেনে রাখা প্রয়োজন এসিডিক ও ক্ষারীয় অবস্থা মাপার স্কেলের নাম pH স্কেল। পি এইচ স্কেলে ০ থেকে ৭ পর্যন্ত দাগ কাটা থাকে। কোন জিনিসের পিএইচ ৭ হলে সেটা নিরপেক্ষ অর্থাৎ এসিডিক বা অ্যালকালাইন কোনটাই না। আর পি এইচ এর মান সাত থেকে যত নিচে নামতে থাকবে তা ততো এসিডিক। এবং ৭ থেকে যত উপরে উঠতে থাকবে তা তত ক্ষারীয় বা অ্যালকালাইন। সাধারণ খাবার পানির পিএইচ ৭ অর্থাৎ সাধারণ খাবার পানি নিরপেক্ষ।
এখন আসি আমাদের মূল প্রশ্নে –
অ্যালকালাইন খাবার কি?
অ্যালকালাইন খাবার হল এমন খাবার যাতে ক্ষারের ভাগ বেশি বা যার পি এইচ ৭ এর বেশি এবং যাতে আমাদের দেহের অত্যাবশ্যকীয় মিনারেল – সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি থাকে।
শিশুকালে আমাদের দেহটা ছিল অ্যালকালাইন। পরে এসিডিক খাবার বেশি বেশি খাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে সেটা এসিডিক হয়ে যায়। কারণ আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতা এসিডিক খাবারের দিকে, অ্যালকালাইন খাবারের দিকে নয়।
মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ভাত, রুটি, প্রসেসড ফুড, জাঙ্ক ফুড ইত্যাদি সবই এসিডিক।
তাই সুস্থ থাকার জন্য আমাদের দেহের দাবি এটাই যে, আমরা যেন অ্যালকালাইন খাবার খাই। অ্যালকালাইন খাবার খেয়ে দেহটাকে অ্যালকালাইন স্টেটে রাখি।
আমরা যদি এসিডিক খাবার খেয়ে আমাদের পাকস্থলী, রক্ত, লিভার, কিডনি তথা সমগ্র দেহটাকে এসিডিক করে রাখি তাহলে সেটা হয়ে উঠবে ক্যান্সার সহ প্রায় সমস্ত রোগ উৎপাদনের ফ্যাক্টরি। কারন আমরা জানি, আমাদের দেহের প্রায় ৮৫% রোগ হয় পেট থেকে।
অ্যালকালাইন খাবার কেন খাব?
এসিডিক দেহ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের দেহের প্রায় সমস্ত রোগের সাথে সম্পর্কিত। তাই দেহের স্বাস্থ্য, সুস্থতা, স্থিতিশীলতা আর রোগ সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করার পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমাদের দেহকে অ্যালকালাইন স্টেটে রাখতে হবে তথা এসিডিক অবস্থাকে প্রশমিত করে রাখতে হবে।
সঙ্গত কারণেই এ কাজটা শুরু করতে হবে আমাদের পেট থেকে। কারন আমরা জানি পেট থেকে আমাদের দেহের প্রায় ৮৫% রোগের উৎপত্তি।
আর পেট এসিডিক হলে দেহের অন্যান্য অংশ রক্ত, কোষ, লিভার সহ সমগ্র দেহই এসিডিক হয়ে যাবে।
তাছাড়া পেট হল খাদ্য পরিপাকের কেন্দ্র যেখানে প্রতিনিয়ত হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপন্ন হচ্ছে। আর পেট এসিডিক হলে পেটেরি বিভিন্ন সমস্যা যেমন গ্যাস্ট্রাইটিস, এসিড রিফ্লাক্স, হজমে গোলমাল, পেটে গ্যাস হওয়া, বুক জ্বালা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে দেহে অশান্তি লেগে থাকে। এই অভিজ্ঞতা নিশ্চয় কমবেশি আমাদের সবারই আছে।
সুতরাং সমস্ত দেহকে এসিডিক অবস্থায় রাখতে হলে সবার আগে পেট কে অ্যালকালাইন করতে হবে এবং অ্যালকালাইন রাখতে হবে, আর তা করতে হবে খাবারের মাধ্যমে।
চলুন আমরা আমাদের দেহের এসিডিটি (অম্লত্ব) ও অ্যালকালাইনিটি (ক্ষারত্ব) তথা pH সম্পর্কে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেই –
- ☀ সুস্থ মানব দেহের অভ্যন্তরীণ pH সাধারণত ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫ এর মধ্যে থাকে, যা সামান্য ক্ষারীয়। এই সামান্য ক্ষারীয় অবস্থা বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
- ☀ কারো রক্তের পিএইচ লেভেল যদি ৭-এর নিচে নেমে যায় তবে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
- ☀ রক্তের পিএইচ যদি 6.8এর নিচে নেমে যায় তবে জ্ঞান হারাতে পারে, এমনকি কোমায় চলে যেতে পারে।
অ্যালকালাইন ও এসিডিক খাবার কিভাবে চিনব?
সহজ ভাষায় মনে রাখা যায়, এভাবে- প্রধানতঃ শাকসব্জি ও ফল জাতীয় খাবার হল এলকালাইন ফুড আর মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ভাত-রুটি এগুলো হল এসিডিক ফুড।
একনজরে আমরা এলকালাইন ফুড ও এসিডিক ফুডের তালিকাটা দেখে নিই-
➤ এলকালাইন ফুড
- সব ধরনের শাকসব্জি
- সব ধরনের ফল
- বাদামঃ কাজু বাদাম, কাঠ বাদাম ইত্যাদি
- বীজঃ মিষ্টি কুমড়ার বীজ
- অয়েলঃ অলিভ অয়েল।
- সামুদ্রিক খাবার
- অংকুরিত খাবারঃ অংকুরিত ডাল, ছোলা, গম ইত্যাদি
- মসলা
- গ্রীন টি, হারবাল টি
- গ্রীন কফি ইত্যাদি
➤ এসিডিক ফুড
- ডিম
- মাছ
- মাংস
- ভাত
- রুটি
- দুধ
- মিষ্টি
- ডেইরি প্রোডাক্ট
- জাঙ্ক ফুড, প্রসেস্ড ফুড,
- সফট ড্রিংক, ফ্রুট ড্রিংক ইত্যাদি
অ্যালকালাইন খাবার কখন, কতটুকু, কিভাবে খাবেন?
স্বাভাবিক সুস্থ অবস্থায় আপনি ৭০% এলকালাইন ফুড এবং ৩০% এসিডিক ফুড খাবেন।
আর এসিডিটির ফার্স্ট স্টেজে থাকলে আপনি ৭৫% থেকে ৮০% এলকালাইন ফুড এবং ২০% থেকে ২৫% এসিডিক ফুড খাবেন। আর যদি আপনি এসিডিটির সেকেন্ড স্টেজে থাকেন তাহলে ৮০% এলকালাইন ফুড অবশ্যই খেতে হবে। আর এসিডিটির থার্ড স্টেজে থাকলে আপনাকে অবশ্যই ৯০% এলকালাইন ফুড ও অবশিষ্ট এসিডিক ফুড খেতে হবে।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, আপনি বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্যও যদি বিভিন্ন ধরনের খাবার চোজ করেন, তাও আপনাকে হিসাব করে খেতে হবে যে- আপনার সারাদিনের খাবারে কত পারসেন্ট এলকালাইন এবং কত পারসেন্ট এসিডিক ফুড খাচ্ছেন।
বেকিং সোডাঃ এসিডিক দেহকে এলকালাইন করার সায়েন্টিফিক পদ্ধতি
আমরা আপনার পাশের দোকানে পাওয়া সাধারন বেকিং সোডা বা খাবার সোডার কথা বলছিনা। বলছি আন্তর্জাতিক মানের ফুড গ্রেড বেকিং সোডার কথা। দেহকে এককালাইন করার এবং এলকালাইনিটি ধরে রাখার একটা বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি হল- ফুড গ্রেড বেকিং সোডা খাওয়া।
আপনি যদি প্রচন্ড এসিডিটি বা পেটের গ্যাসের সমস্যায় ভগেন বা আপনার শরীরের pH কম থাকে বা আপনার বয়স ৫০ এর বেশি হয়, তাহলে আপনি অনেক ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা এড়াতে নিয়মমাফিক বেকিং সোডা খেতে পারেন।
কিন্তু আপনি কোন ধরনের, কোন ব্রান্ডের বেকিং সোডা কতটুকু, কতদিন পর পর, কিভাবে খাবেন- এ সম্পর্কিত সাধারন ধারনা আপনার থাকা আবশ্যক। এই সংশ্লিষ্ট সমস্ত তথ্য নিয়ে আমাদের অন্য একটি পোস্ট আছে, এখনই দেখে নিন-
পড়ুন: ফুড গ্রেড বেকিং সোডাঃ পেটের স্বাস্থ্যের জন্য খাবার ও ওষুধ
অ্যালকালাইন ওয়াটারঃ এসিডিটির বিরুদ্ধে আর একটি অস্ত্র
পেট ও বডিকে অ্যালকালাইন করতে অ্যালকালাইন পানিও যোগ করে নিন আপনার লাইফস্টাইলে।
সাধারণ খাবার পানি হয় নিরপেক্ষ অর্থাৎ না এসিডিক না অ্যালকালাইন। তাই আমরা বডিকে অ্যালকালাইন করতে নিজেরা অ্যালকালাইন ওয়াটার বানিয়ে পান করতে পারি যা মোটেই ব্যয়বহুল নয়।
পানিতো এমনিতেই খেতে হয়। যদি আপনি দিনের শুরুতেই একটি বড় জগে এলকালাইন পানি তৈরি করে নেন, তাহলে সারাদিন এই পানি খেতে পারেবন। বডিকে এলকালাইন রাখার চ্যালেঞ্জে এলকালাইন পানি হতে পারে বড় সহায়ক।
চলুন দেখে নিই কিভাবে এলকালাইন পানি তৈরি করতে হয়-
এলকালাইন পানি তৈরির পদ্ধতি
- ☛ একটি বড় জগে এক লিটার বিশুদ্ধ পানি নিন।
- ☛ একটি মাঝারি আকারের শসা স্লাইস করে নিন এবং এডড করুন।
- ☛ একইভাবে একটি মাঝারি আকারের লেবু স্লাইস করে পানিতে যোগ করুন।
- ☛ সাথে দিতে পারেন লেটুস পাতা।
- ☛ ২/১ ঘন্টা রেখে দিন। তৈরি হয়ে গেল এলকালাইন ওয়াটার। এবার খেতে পারেন।
- ☛ গ্লাসে ঢেলে খাওয়ার সময় সম্ভব হলে গ্লাসে একটু হিমালয়ান পিঙ্ক সল্ট মিশিয়ে নিন।
এই পানি ১২ ঘন্টা পর্যন্ত রেখে খেতে পারবেন।