প্রিয় পাঠক-
এই আর্টিক্যালের বেশিরভাগ তথ্য ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের লাইভ ভিডিও ও তার বিভিন্ন বক্তব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রশান্তি ডট কম এ ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের জন্য আছে বিশেষ ফোকাস। নিচের লিঙ্ক থেকে ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন-
⇲ রোগীর আত্বীয় ডাঃ জাহাঙ্গীর কবির ও একটি স্বাস্থ্য বিপ্লবের গল্প
⇲ ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের জে. কে. লাইফস্টাইলঃ ঘুনে ধরা দেহে নতুন ফাউন্ডেশন
বুঝে নিই ফ্যাট এডাপ্টেশন (Fat Adaption)

ফ্যাট এডাপ্টেশন (Fat Adaptation) এর মানে হল চর্বি অভিযোজন। ফ্যাট এর সাথে এডাপ্টেড বা অভিযোজিত বা অভ্যস্ত হয়ে চলা। তার মানে শরীরের ফ্যাট বা চর্বি খরচ করে চলা। অন্যভাবে, শরীরের ফ্যাট বার্ন করে বা পুড়িয়ে সেই শক্তি দিয়ে চলা। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের ভাষায় “নিজের তেলে চলা”। অর্থাৎ দেহের চর্বিকে যদি জ্বালানি তেলের সাথে তুলনা করা হয়, তাহলে সেই তেল পুড়িয়ে দেহ গাড়িটাকে চালিয়ে নেওয়া।
আমাদের সবার শরীরেই তো চর্বি আছে, তাই নয় কি? কিন্তু ফ্যাট এডাপ্টেশন কথাটি প্রযোজ্য তাদের ক্ষেত্রে যাদের শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট আছে। পৃথিবীর হাসপাতালগুলোকে বেশিরভাগ ব্যস্ত রেখেছে অতিরিক্ত চর্বিওয়ালা মানুষেরা। কারন অতিরিক্ত চর্বি থেকে কোটিপতির রোগ বলে পরিচিত ডায়াবেটিসের পথ ধরে হৃদ্রোগ, হার্ট স্ট্রোক, ব্রেইন স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা সহ সব রোগই দেহে বাসা বাঁধে।
সুতরাং যাদের শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাট আছে- জীবন জন্য, সুস্থতার জন্য- তাদের শরীর থেকে ফ্যাট ঝরিয়ে ফেলতে হবে। আর এর জন্যই ফ্যাট এডাপ্টেশন (Fat Adaptation)।
তাহলে চলুন আমরা ক্রমান্বয়ে শিখে নিই, শরীরে কেন ফ্যাট জমে, কেন ফ্যাট এডাপ্টেশন আপনার জন্য প্রয়োজন এবং কীভাবে ফ্যাট এডাপ্টেড হয়ে চলা যায় বা নিজের তেলে চলা যায় আর এর সুফলই বা কি।
কেন ও কিভাবে আমাদের শরীরে ফ্যাট জমে
আমাদের শরীরে কয়েকভাবে ফ্যাট জমতে পারে। প্রথমত অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে। অর্থাৎ আমরা যখন চর্বিযুক্ত খাবার- মাংস, তৈলাক্ত মাছ, ডিম, তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি অতিরিক্ত পরিমাণে খাই, তখন এর কিছু অংশ দেহে খরচ হয়ে যায়। আর অতিরিক্ত অংশ দেহে চর্বি হিসাবে জমা হয়। কোথায় জমে হয়? এই ফ্যাট বা চর্বি শরীরের বিভিন্ন জায়গায়- কোষে, পেশিতে, পেটে, উরুতে, লিভারে, হার্টে, ব্রেইনে জমা হয়।
ফ্যাট বা চর্বিযুক্ত খাবার ছাড়াও অন্যান্য ক্যালরিযুক্ত খাবার- প্রোটিন এবং শর্করা ও দেহে প্রয়োজনীয় অংশ ব্যবহৃত হওয়ার পর অতিরিক্ত অংশ রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে চর্বি আকারে কোষে গিয়ে জমে হয়। এই অতিরিক্ত ফ্যাট জমতে জমতে কোষ ওভারলোড হয়ে গেলে বা কোষে আর জায়গা না থাকলে ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স (Insulin Resistance) এর পথ ধরে ডায়াবেটিস হয়। ডায়াবেটিস হলে তো আর কথাই নেই। দেহটা ক্যান্সার সহ অনেক মরনঘাতি রোগ সৃষ্টির কারখানা বা ব্রিডিং গ্রাউন্ড হয়ে যায়।
এই অতিরিক্ত চর্বি বিভিন্নভাবে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের ব্রেইনকে অকেজো করে দেয়, লিভারে ফ্যাটি লিভার সৃষ্টি করে, রক্তনালি ব্লক করে দেয়, হার্টে ব্লক সৃষ্টি করে ও হার্টকে দুর্বল করে দিয়ে স্ট্রোক এর মত ঘটনা ঘটায়। আর দৃশ্যত ওবেসিটি (Obesity) বা ওজন বৃদ্ধির কারন হয়।
ফ্যাট এডাপ্টেশন কেন আপনার জন্য প্রয়োজন?
তাহলে তো বুঝতেই পারলেন, বাঁচতে হলে দেহ থেকে ফ্যাটকে/চর্বিকে বিদায় দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ফ্যাটতো এখানে সেখানে ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি হয়ে আছে। আর আমরা সাধারণত এর ফাঁদে ধরা দিতেই অভ্যস্ত।
স্বাভাবিকভাবে আপনার দেহ থেকে ফ্যাট দূর হয়না, দূর হবেনা। কারন আপনি প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্ব বা শর্করা খাচ্ছেন, অর্থাৎ- ভাত, রুটি, চিনি, মিষ্টি ইত্যাদি খাচ্ছেন। শর্করা রক্তে আসে চিনি আকারে। দেহ সর্বপ্রথম এই শর্করা থেকেই আপনার হাঁটাচলা, কাজকর্মের জন্য যে শক্তি প্রয়োজন সেই শক্তি নিয়ে নেয়। সঞ্চিত চর্বি খরচের আর সুযোগ হয়ে উঠেনা। এমনকি আপনার ৬০ বছরের জীবনেও না, যদি না আপনি এই চর্বির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। এই যুদ্ধটাই হল ফ্যাট এডাপ্টেশন (Fat Adaptation) করা।
প্রশ্নঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন ছাড়া অন্য কোনভাবে কি চর্বি কমানো যায়না?
উত্তরঃ যথাযথ সময়ে যথার্ত প্রশ্ন। উত্তর হল- হ্যাঁ, কমানো যায়। ইদানিং চর্বি কমানোর ট্যাবলেটও বের হয়ে গেছে। ডাক্তাররা তা প্রসক্রাইব করেন। এই ট্যাবলেট খেলে পায়খানার রাস্তা দিয়ে চর্বি বেরিয়ে আসে। এটা একটা নিষ্ঠুর পদ্ধতি মনে হয় আমার কাছে। আর ট্যাবলেট মানেই তো আরেকটা জটিলতা, আরেকটা অসুস্থতা। এই পদ্ধতিতে কেউ ১০/২০/৩০ কেজি ওজন কমিয়ে সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে পারছেন কিনা তা আমার জানা নেই।
তবে আমরা ঔষধ নির্ভরতার পথ ধরে নয়, আল্লাহর দেওয়া, ঔষধবিহীন-প্রাকৃতিক বিধানের পথ ধরেই হাঁটব।
আরো প্রশ্ন থেকে যায়, নিয়মিত হেঁটে, দৌড়াদৌড়ি করে বা ব্যায়াম করে কি চর্বি কমানো যায়না? হ্যাঁ যায়। এভাবে যদি আপনি কখনো চর্বি কমাতে সফল হন, তাহলে সেটাই হয়ে যাবে ফ্যাট এডাপ্টেশন পদ্ধতি। আপনি যদি ব্যায়াম করে এসে পেট ভরে বিরিয়ানি খান বা প্রচুর কার্ব খান, তাহলে ফ্যাট গলার সময় পাবে কোথায়?
জেনে নিই ফ্যাট এডাপ্টেশন কি
ফ্যাট এডাপ্টেশন হল শরীরে সঞ্চিত বা জমা হওয়া চর্বি খরচ করে চলা। আমাদের প্রতিদিনের চলাফেরা-কাজকর্মে যে শক্তি প্রয়োজন তা কিন্ত প্রথমত চর্বি থেকে খরচ হয়না। খরচ হয় কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা থেকে। তাই যারা বেশি শর্করা জাতীয় খাবার খায়, যেমন- তিন বেলা ভাত খায় (বিশেষ করে বাঙ্গালিরা), তারা যদি ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের মাধ্যমে সেটা বার্ন না করে বা খরচ না করে, তাহলে তা দেহে চর্বি হিসাবে জমা হয়। যেহেতু তারা শর্করা খাওয়ার অভ্যাসের বৃত্তে আটকে থাকে, তার আর এই চক্র থেকে বের হতে পারেনা। ফলে শরীরে ফ্যাট ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।
ফ্যাট এডাপ্টেশন হল শর্করা কম খেয়ে এবং চর্বি বেশি খেয়ে দেহকে চর্বি বার্ন করে বা পুড়িয়ে বা খরচ করে চলার সুযোগ করে দেওয়া। ডাঃ জাহাঙ্গীর কবিরের মতে, ফ্যাট এডাপ্টেশন এর শুরুতে শর্করা খেতে হবে ৫%, প্রোটিন ২০% এবং ফ্যাট ৭৫%। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ-
ফ্যাট এডাপ্টশন প্রক্রিয়া
শুরুতে শর্করা খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিতে হবে (৫%), তাও শুধু শাকসব্জি থেকে এ শর্করা নিতে হবে। ভাত, রুটি, ফল, দুধ, মুড়ি, চিড়া, খই, মিষ্টি, মিষ্টিজাতীয় খাবার সহ সব ধরনের শর্করা একেবারে বাদ দিতে হবে। প্রোটিন খেতে হবে ২০%। অবশিষ্ট চর্বি খেয়ে পূর্ণ করতে হবে। এই চর্বির মধ্যে থাকবে- মাছ, মাংস, ডিমের কুসুম, ঘি, নারিকেল তেল, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ইত্যাদি।
পাশাপাশি না খেয়ে থাকার অভ্যাস করতে হবে। এতে বডি কার্বোহাইড্রেট খরচ করে উৎপাদিত গ্লাইকোজেনও খরচ করে ফেলবে। এর পর ফ্যাট বার্নিং শুরু হয়ে যাবে। একবার ফ্যাট বার্নিং শুরু হলে তা চলতে থাকবে। এই প্রক্রিয়াটি ৪, ৫ বা ৭ দিন লাগতে পারে।
ফ্যাট বার্নিং শুরু হয়ে গেলে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে। সারাদিন না খেয়ে থাকলে বা রোজা রাখলেও ক্ষুধা লাগবেনা। কারন এখন বডি দেহের সঞ্চিত ফ্যাট বা চর্বি খরচ করে চলছে। আমরা দেখতে পাই (সাধারণত গ্রামে), কুনো ব্যাঙেরা শীতকালে ঘরের কোনে শীতনিদ্রায় যায়। সম্পূর্ণ শীতে এরা বের হয়না। তাহলে বাঁচে কিভাবে? উত্তর হল- ফ্যাট এডাপ্টেশন পদ্ধতিতে। এদের গায়ে সঞ্চিত চর্বি খরচ করে পুরো শীতকালটা পার করে দেয়।
ফ্যাট এডাপ্টেশন এ ব্যাঙের মত মানুষের ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
নিয়ম মেনে চলতে থাকলে এক সময় দেহের অপ্রয়োজনীয় ওজন ঝরে যাবে। কোষ চর্বিমুক্ত হবে। এভাবে অনেক রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
প্রশ্নঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন এর কি বিকল্প কোন পদ্ধতি আছে?
উত্তরঃ রোজা হল ফ্যাট এডাপ্টেশনের প্রাকৃতিক বিকল্প। বেশি বেশি রোজা রাখলে খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে সীমালঙ্গন না করলে যে কেউ ফ্যাট এডাপ্টেড হতে পারবে। আল্লাহর রাছুল (সাঃ) প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। এছাড়া প্রতি চান্দ্র-মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখতেন। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কেউ একসাথে কয়েকদিন ফাস্টিং বা উপবাস করলেও ফ্যাট এডাপ্টেশন হবে।
প্রশ্নঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন এর উপকারিতা কি কি?
উত্তরঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন এর অনেক উপকারিতা রয়েছে; যেমন-
- ওজন হ্রাস (Weight loss)।
- চর্বিমুক্ত দেহ।
- সুগার নিয়ন্ত্রনে আসা।
- ডায়াবেটিস নির্মূল। ফলে ডায়াবেটিস সংশ্লিষ্ট সকল রোগ প্রতিরোধ।
- দেহ ডিটক্সিফাই হয়।
- উন্নত ঘুম।
- শারীরিক দুর্বলতা থেকে মুক্তি ও এনার্জি বৃদ্ধি।
- ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।
প্রশ্নঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন এর উপকারিতা অর্জিত হওয়ার পর কি একই ডায়েট (Diet) অনুসরন করার দরকার আছে?
উত্তরঃ ফ্যাট এডাপ্টেশন এর মাধ্যমে ওজন ও চর্বি নিয়ন্ত্রনে চলে এলে প্রয়োজনীয় পরিমাণে শর্করা ও চর্বি খাওয়া যাবে এবং খেতে হবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ও লাইফস্টাইল অনুসরণের মাধ্যমে ওজন, ফ্যাট ও চর্বি সঠিক লেভেলে রাখতে হবে।
ফ্যাট এডাপ্টেশন এর সময় সাবধানতা
ফ্যাট এডাপ্টেশন এর অতিরিক্ত ব্যায়াম করা যাবেনা। অতিরিক্ত ব্যায়াম করলে বা শারীরিক Activity করলে দেহ গ্লুকোজ চাবে। গ্লুকোজ না দিলে দেহ দুর্বল হয়ে পড়বে। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এ সময় HIIT (High Intensity Interval Training) করা যাবেনা। শুধু Aerobic zone এ ব্যায়াম করতে হবে।
কার্ব বা শর্করা বিহীনভাবে চলায় অভ্যস্ত হয়ে গেলেও লক্ষ অর্জিত হয়ে গেলে সহনীয় পরিমাণে শর্করা খেতে হবে। তা না হলে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।