ফ্যাটি এসিডঃ চিনে নিন সুস্থ্য জীবনের জন্য উপকারি ও কার্যকারি ফ্যাটি এসিড

Diabetes check-up

স্বাস্থ্য সচেতন এবং শিক্ষার্থীরা ফ্যাটি এসিড সম্পর্কে সহজ ভাষায় জেনে নিন।

ফ্যাটি এসিড সম্পর্কে জানতে গেলেই আপনি দেখবেন বৈজ্ঞানিক ভাষার ঘুরপাকে আপনি হারিয়ে গেছেন আর আপনি পড়া ত্যাগ করে চলে গেছেন।

আমরা কথা দিচ্ছি, এই পোস্টে আপনার ব্যক্তিগত ঘরোয়া ভাষায় সহজভাবে ফ্যাটি এসিড সম্পর্কে আপনাকে বুঝিয়ে দেব, ইনশাল্লাহ।

ফ্যাটি এসিড কি- শিখে ফেলি

আমরা জানি, আমরা যত ধরনের খাদ্য প্রতিদিন খাই, তার মধ্যে ছয় ধরনের খাদ্য উপাদান আছে- শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন বা আমিষ, ফ্যাট বা চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ এবং পানি।

Animal Fat
ফ্যাটি এসিড

তার মধ্যে একটি উপাদান হল ফ্যাট বা চর্বি।

এই চর্বির আছে অনেক ধরনের রকমফের। যেমন চর্বি, কোলেস্টেরল, ট্রাই গ্লিসারাইড এবং আমাদের আলোচ্য ফ্যাটি এসিড।

ফ্যাটি এসিড হলো, এক কথায় চর্বির মূল গঠন উপাদান বা বিল্ডিং ব্লক।

আমরা যখন চর্বি জাতীয় খাবার খাই, হজমের সময় সেগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুতে বিভক্ত হয়ে যায় যা পরে রক্তে সহজে শোষিত হতে পারে এগুলোই ফ্যাটি এসিড।

এই ফ্যাটি এসিডকে আবার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে শ্রেণীবিভক্ত করা হয়; যেমন-

দৈর্ঘ্য অনুসারে

ফ্যাটি এসিডে কার্বন পরমাণু একের পর এক মিলিত হয়ে যে লম্বা চেইন বা শিকল তৈরি করে তার দৈর্ঘ্য অনুসারে বা কার্বন পরমাণুর সংখ্যা অনুসারে ফ্যাটি এসিডকে চার ভাগে ভাগ করা হয-

  • শর্ট-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (SCFAs)
  • মিডিয়াম-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (MCFAs)
  • লং-চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (LCFAs) এবং
  • খুব লম্বা চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড (VLCFAs)

সম্পৃক্ততা এবং অসম্পৃক্ততা অনুসারে

এই দৃষ্টিকোণ থেকে সেটি এসিডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়-

  • সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড
  • অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড।

যাই হোক, ডায়েট নির্ধারণের গুরুত্ব থেকে এই বিভাগটিই আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

তাই আমরা সম্পৃক্ত এবং অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড নিয়েই আলোচনা করব।

কার্বনের জোড়-বিজোড় শৃংখল অনুসারে

: এটি এসিড অনুতে কার্বন পরমাণুর শৃংখলে জোড় সংখ্যক পরমাণু আছে নাকি বিজোড় সংখ্যক পরমাণু আছে তার উপরে ভিত্তি করে ফ্যাটি এসিড দুই প্রকার;

  • জোড় শৃঙ্খলিত ফেটি অ্যাসিড
  • বিজোড় শৃঙ্খলিত ফ্যাটি এসিড

পূর্বেই বলেছি- আমরা সম্পৃক্ত (Saturated) এবং অসম্পৃক্ত (Unsaturated) ফ্যাটি এসিড কে ফোকাস করব। কারন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো এই দুই ধরনের ফ্যাটি এসিডের আলোচনায় ক্লিয়ার হয়ে যাবে।

সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Saturated Fatty Acids):

Formation of Saturated Fatty Acid
স্যাচুরেটেড (ক্ষতিকর) ফ্যাটি অ্যাসিড এর গঠন

সম্পৃক্ত কথাটির অর্থ হলো সংযুক্ত বা একত্রিত অর্থাৎ যে ফ্যাটি এসিডের পরমাণুগুলো আলাদা বা বিশ্লিষ্ট নয়, একত্রিত ঘন সন্নিবিষ্ট। বিজ্ঞানের ভাষা প্রয়োগ করে বলা যায়- এই ফ্যাটি এসিডে কার্বন-কার্বন দ্বি-বন্ধন (C=C) অনুপস্থিত থাকে।

অর্থাৎ সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের বৈশিষ্ট্য হলো

  • এই ফ্যাটি এসিডে কার্বন চেইনে কোন ডাবল বন্ড বা দ্বিবন্ধন থাকে না।
  • কার্বন-কার্বন দ্বি-বন্ধন (C=C) থাকেনা- এই কথার সহজে বোধগম্য অর্থ হল- একে সহজে বিশ্লিষ্ট করা যায়না অর্থাৎ সাধারণ তাপমাত্রায় বা কক্ষ তাপমাত্রায় এই এসিড কঠিন বা সলিড থাকে, যেমন- মাখন, পাম তেল, পশুর চর্বি, নারকেল তেল ইত্যাদি।
  • আমরা যদি অতিরিক্ত সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড গ্রহণ করি, তাহলে তা আমাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

এবার আসি অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Unsaturated Fatty Acids) এর কথায়-

আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Unsaturated Fatty Acids)

Formation of Unaturated Fatty Acid
আনস্যাচুরেটেড (উপকারী) ফ্যাটি অ্যাসিড এর গঠন

অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে অধিক স্বাস্থ্যবান্ধব বলে বিবেচিত।

চলুন অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড এর কয়েকটি সাধারন বৈশিষ্ট্যের কথা জেনে নিই-

অর্থাৎ অসম্পৃক্ত (Unsaturated) ফ্যাটি এসিডের বৈশিষ্ট্য হলো

  • অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড এ এক বা একাধিক কার্বন-কার্বন দ্বি-বন্ধন (C=C) থাকে।
  • সাধারনত এটি সাধারন তাপমাত্রায় তরল থাকে, যেমন- অলিভ অয়েল, উদ্ভিজ্জ তেল।
  • অসম্পৃক্ত ফ্যাট সম্পৃক্ত ফ্যাট এর চেয়ে অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত বলে প্রমানিত।

অসম্পৃক্ত বা ফ্যাটি অ্যাসিড এর আবার কয়েকটি ভাগ আছে

➽ মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Monounsaturated Fatty Acids):

মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোতে কার্বন চেইনে একটিমাত্র দ্বিবন্ধন বা ডাবল বন্ড থাকে।

মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আমাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল বা LDL এর মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং স্বাভাবিকভাবেই হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে আমাদের কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়।

উদাহরণ: অলিভ অয়েল, অ্যাভোকাডো, বাদাম।

➽ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (Polyunsaturated Fatty Acids):

পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডগুলোতে কার্বন চেইনে একাধিক দ্বি-বন্ধন বা ডাবল বন্ড থাকে।

পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে LDL এর মাত্রা কমাতে ভূমিকা রাখে এবং ভালো কোলেস্টেরল বা HDL এর মাত্রা বাড়ায়।

উদাহরণ: মাছের তেল, সূর্যমুখী তেল, সয়াবিন তেল।

পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের মধ্যে আমাদের অনেকেরই পরিচিত ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 Fatty Acids)

Omega 3 Fatty Acid food
উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডযুক্ত খাবার

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-3 Fatty Acids) হার্টের রোগের ঝুঁকি কমায়, ব্রেইনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে এবং Inflammation বা প্রদাহ কমায়।

ফুসফুসের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মনের সাথে সম্পর্কিত রোগ উদ্বেগ, স্ট্রেস, বিষন্নতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।

উদাহরণ: স্যামন মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।

ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-6 Fatty Acids)

ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড (Omega-6 Fatty Acids) ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এর মতই উপকারী। তবে এটি সাধারন মানুষের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়। আমাদের শরীরে বিভিন্ন কাজে শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশ নেয়। এটিও হার্টের সুস্থতার জন্য দারুন সহায়ক।

এটি শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশে সাধন করে। এবং মস্তিষ্ককে অধিকতর অ্যাক্টিভ রাখতে সাহায্য করে।

এছাড়া এটি ত্বক এবং চুলের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে, হাড় সুস্থ রাখে, মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে।

উদাহরণ: স্যামন মাছ, ফ্ল্যাক্সসিড, চিয়া সিড, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ইত্যাদি।

উদাহরণ: কর্ন অয়েল, সয়াবিন তেল।

মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড ইনফ্ল্যামেশন বাড়াতে পারে।

➽ ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (Trans Fatty Acids):

ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (Trans Fatty Acids) বা ট্রান্সফ্যাট এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো

ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড (Trans Fatty Acids) এক ধরনের আনস্যাচুরেটেড বা অসম্পৃক্ত ফ্যাট। তবে এগুলো শিল্প কারখানায় প্রসেসিং এর ফলে তৈরি হয়।

ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড বা ট্রান্স ফ্যাট রক্তে LDL কোলেস্টেরল এর মাত্রা বাড়ায় এবং ভালো কোলেস্টেরল বা HDL এর মাত্রা কমায়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হার্টের রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

উদাহরণ: প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, কিছু বেক করা খাবার।

শেষকথা

সংক্ষেপে বলা যায়, আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (বিশেষ করে ওমেগা-৩) আমাদের হৃদস্বাস্থ্য এবং একই সাথে সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। স্যাচুরেটেড ফ্যাট পরিমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত এবং ট্রান্স ফ্যাট একেবাড়ে এড়িয়ে চলাই ভাল।

☘ পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
☘ কমেন্ট করুন প্লিজ, আপনার কমেন্ট এপ্রিশিয়েট করা হবে।
☘ ফ্যাটি এসিড সম্পর্কে কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে নির্দিধায় প্রশ্ন করুন, আপনার প্রশ্নের উত্তর পরবর্তী আপডেটে অন্তর্ভূক্ত করা হবে।

মন্তব্য করুন