বাংলাদেশী চিকিৎসক ডা. মনিরুজ্জামান (Dr. Moniruzzaman) একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক। তিনি স্থূলতা, হৃদরোগ, ফ্যাটি লিভার, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর সমাধানে অনলাইন মাধ্যমে এবং রিয়াল লাইফে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। কোয়ান্টাম হার্ট ক্লাবের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে তার নেতৃত্ব অসংখ্য মানুষ সুস্থ হয়েছেন এবং তাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে ।
এই পোস্টে আমরা পৃথিবীর এক নম্বর খাবার বা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার নিয়ে আলোচনা করব। ওয়ার্ল্ড’স নাম্বার ওয়ান ফুড নিয়ে।
আর সেটি হচ্ছে- বাদাম বা নাট (Nut)
এতকিছু থাকতে বাদাম কেন নাম্বার ওয়ান ফুড
কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীর ১০০০ খাবার নিয়ে গবেষণা করলেনগবেষণা করে। এর মধ্যে থেকে ১০০ খাবারকে তারা শ্রেষ্ঠ খাবার হিসেবে সনাক্ত করলেন। এবং এই ১০০ খাবারের মধ্যে এক নম্বর তালিকায় যে খাবারটিকে তারা রাখলেন-
সেটি হচ্ছে বাদাম।
এবং এই বাদামের ভিতরে যে দুটো বাদামকে তারা একদম উপরের দিকে রাখলেন, সেটি হচ্ছে আখরোট বা ওয়ালনাট। আরেকটি হচ্ছে কাঠবাদাম বা আলমন্ড বা আমন্ড।
এত খাবার থাকতে বাদাম কেন শ্রেষ্ঠ খাবার হলো? হোয়াই?
তো চলুন আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করি যে কেন বাদাম এক নম্বর খাবারের মর্যাদা লাভ করলো।
বাদামে থাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাট যার নাম হচ্ছে এসেনশিয়াল ফ্যাটি এসিড। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড (Omega-3 Fatty Acid)। এর আর একটা নাম হচ্ছে ইঞ্জিন ওয়েল (Engine Oil)।
বাদামকে কেন দেহের ইঞ্জিন ওয়েল বলা হচ্ছে?
আমরা জানি যে কোনো ভেহিকল যেকোনো ভেহিকল বা যানবাহন চলাচলের জন্য তার জ্বালানি দরকার- পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, যেগুলো পুড়ে যানবাহন চলাচল করে। এবং সেই যানবাহনের ইঞ্জিন যেন স্মুথলি (Smoothly) দীর্ঘদিন চলতে পারে। সেই জন্যে সেই ইঞ্জিনের জন্যে একটা বিশেষ লুব্রিক্যান্ট ব্যবহার করা হয়।
এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় লুব্রিক্যান্ট হচ্ছে মবিল। এই লুব্রিক্যান্ট মবিলকে বলা হয় ইঞ্জিন ওয়েল।
আমাদের শরীরও একটা যানবাহন। এবং এই যানবাহনের মূল জ্বালানি হচ্ছে গ্লুকোজ। যেটা পুড়ে শক্তি তৈরি হয়, আমরা কাজ করি।
এবং এই যানবাহন মানে- এই দেহরূপী বাহনের ভিতরে ৭০ থেকে ১০০ ট্রিলিয়ন সেল বা কোষ আছে এবং প্রত্যেকটা সেলের ভিতরে অনেকগুলো ইঞ্জিন আছে। এক একটা সেলের ভিতরেও একাধিক ইঞ্জিন আছে। এবং এই ইঞ্জিনগুলো একাধিক নয়, লক্ষাধিক রিয়্যাকশন হয় এই সেলের ভিতরে। ইঞ্জিনগুলো সারাদিন ধরে সচল থাকে। এবং এই ইঞ্জিনগুলোর কর্মক্ষমতার ফলেই তৈরি হচ্ছে হরমোন এনজাইম, নানাবিধ উপকারী জিনিস এই সেলের ভিতরে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন আপনার সেলের ভিতরে যে ইঞ্জিনগুলো আছে যেমন মাইটোকন্ড্রিয়া একটা ইঞ্জিন, লাইসোজোম একটা ইঞ্জিন- এরকম অনেক ইঞ্জিন আছে। এই ইঞ্জিনগুলো ঠিকমতো কাজ করবে যখন আপনি ঐ ইঞ্জিনগুলোকে তার প্রয়োজনীয় লুব্রিক্যান্ট দিবেন এবং এই লুব্রিক্যান্টের নাম হচ্ছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড।
এবং এটি পর্যাপ্ত থাকে বাদামে। শুধু তাই নয় আপনি যখন ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড পর্যাপ্ত খাবেন এটা আপনার ব্রেইনের সেরিব্রাল কর্টেক্স শুক্রাণু, শুক্রাশয় এবং চোখের রেটিনার প্রাথমিক গঠন উপাদান হিসেবে কাজ করবে।
ফলে আপনার মস্তিষ্ক চমৎকার কাজ করবে এবং পুরুষদের সেক্সুয়াল লাইফ খুবই চমৎকার থাকবে। এবং এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড কেউ যখন নিয়মিত খাবে, তিনি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবেন। ইট ইজ সো ইম্পর্ট্যান্ট। এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড নামের ইঞ্জিন ওয়েল।
আর কী আছে বাদামে?
কো-এনজাইম কিউ টেন (Co-enzyme Q-10)
বাদামে আছে কো-এনজাইম কিউ টেন। এটি একটি শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট। এবং এই কো-এনজাইম কিউ টেন নামের এন্টি-অক্সিডেন্ট আপনার হৃৎপিণ্ড মস্তিষ্ক এবং পেশীর যত কাজ আছে, এই কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। এমনকি খাবার থেকে শক্তি তৈরির যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়াকেও সহযোগিতা করে কো-এনজাইম কিউ টেন।
শুধু খাবার খেলে চলবে না সেই খাবার তো ইউটিলাইজ হতে হবে। সেই ইউটিলাইজেশনে হেল্প করবে কো-এনজাইম কিউ টেন- যেটা পর্যাপ্ত রয়েছে বাদামে।
অ্যামাইনো এসিড (Amino acid)
বাদামে রয়েছে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অ্যামাইনো এসিড। অ্যামাইনো এসিড মানে হচ্ছে প্রোটিনের বা আমিষের ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় অ্যামাইনো এসিড। এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা অ্যামাইনো এসিড এল-আর্জিনিন থাকে বাদামে। এল-আর্জিনিন আপনার ধমনীর দেয়ালকে সবল করে এবং নমনীয় করে। আপনি যখন জাঙ্ক ফুড খাচ্ছেন, বিরিয়ানি, ফাস্টফুড, জাঙ্ক ফুড, তেলেভাজা খাবার খাচ্ছেন, চর্বিযুক্ত খাবার খাচ্ছেন- খাওয়ার সাথে সাথে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার রক্তনালী শক্ত হয়ে, হার্ড হয়ে যায়, পাইপের মতো শক্ত হয়ে যায়।
তখনই হার্ট অ্যাটাকের ঘটনা ঘটতে পারে বা স্ট্রোকের ঘটনা ঘটতে পারে।
তো এই রক্তনালী কিন্তু ফ্লেক্সিবল, নমনীয়। জাঙ্ক ফুড এবং বিরিয়ানি, তেহারি জাতীয় খাবার এই রক্তনালীগুলোকে হার্ড করে ফেলে, শক্ত করে ফেলে। আপনি যখন রেগুলার এল-আর্জিনিন সমৃদ্ধ বাদাম খাবেন, আপনার রক্তনালী নমনীয় থাকবে, ফ্লেক্সিবল থাকবে, সফট থাকবে। দুই নম্বর এই এল-আর্জিনিন রক্তনালীর ভেতরে যেন ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাট বেঁধে না যায়, সেটা প্রতিরোধ করে।
লক্ষ্য করুন, হৃদরোগ থাকলে ডাক্তাররা কী ওষুধ দেয়? অ্যাসপিরিন খেতে দেয়। অ্যাসপিরিনের কাজটা কী? রক্ত যেন রক্তনালীর ভেতরে জমাট বেঁধে না যায়, ঘন না হয়ে যায়। যদি ঘন হয়ে যায়, হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। স্ট্রোকের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
আপনি যখন এল-আর্জিনিন সমৃদ্ধ রেগুলার বাদাম খাবেন, সেটা রক্তকে তরল রাখবে, রক্ত ঘন হওয়া থেকে রক্ষা করবে। অর্থাৎ অ্যাসপিরিনের কাজ করবে।
এবং এটা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ করবে। স্ট্রোক প্রতিরোধ করবে।
ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন-ই
বাদামে রয়েছে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন-ই।
শরীরের নানাবিধ কাজের জন্যে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন-ই দরকার। বিশেষ করে মহিলারা যখন প্রেগন্যান্ট থাকে তখন গর্ভস্থ শিশুর ব্রেইন নিউরাল টিউব, মস্তিষ্ক গঠনের জন্যে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এবং ত্বকের স্বাস্থ্য এবং চুলের স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভিটামিন-ই। আপনি যখন বাদাম খাবেন আপনার চুল হেলদি হবে, চুল পড়া বন্ধ হবে, চুল ঘন হবে, সুন্দর লাগবে। এবং ত্বক গ্লেজি হবে, স্মুথ হবে। আপনাকে দেখতে কম বয়স্ক লাগবে। দেখতে অ্যাট্রাক্টিভ হবেন আপনি।
বিভিন্ন ধরনের মিনারেল (খনিজ)
বাদামে রয়েছে অনেকগুলো মিনারেল। মিনারেল প্রতিনিয়ত আপনার দেহের নানাবিধ কাজের জন্যে প্রয়োজন, এসেনশিয়াল। কী কী মিনারেল আছে বাদামে? আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক, কপার, সেলেনিয়াম।
আপনি যখন বাদাম খাচ্ছেন পর্যাপ্ত মিনারেল আপনার শরীরে চলে গেল, স্বাভাবিক কাজগুলো সুন্দরভাবে হতে শুরু করলো।
পৃথিবীর দীর্ঘজীবী মানুষদের এলাকা কোনটি?
আমরা যদি দেখি পৃথিবীতে যত দীর্ঘজীবী মানুষদের বসবাস যেসব অঞ্চলে, সেইসব অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে কী দেখবো? পৃথিবীতে অন্তত পাঁচটা এলাকা আছে যে পাঁচটা এলাকাগুলোকে একত্রে বলা হয় ব্লু জোন্স। যে এলাকার মানুষগুলো গড়ে শত বছর বাঁচে। এবং জীবনের শেষদিনও তারা অ্যাক্টিভ লাইফ লিড করে।
কারা কারা?
- ✠ জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপ
- ✠ গ্রিসের ইকারিয়া দ্বীপ
- ✠ ইতালির সার্ডিনিয়া দ্বীপ
- ✠ কোস্টারিকার নিকোয়া পেনিনসুলা এবং
- ✠ ক্যালিফোর্নিয়ার লোমালিন্ডা।
এবং এইসব এলাকা সহ আরো যেসব দীর্ঘজীবী এলাকা, দীর্ঘজীবী মানুষদের এলাকা রয়েছে, এইসব এলাকার মানুষদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বাদাম।
বাদাম কিভাবে খাবেন?
আপনি যদি দীর্ঘ কর্মময় সুস্থ জীবন চান, কী করতে হবে? আপনারও খাদ্য তালিকায় অবশ্যই বাদামকে সংযুক্ত করতে হবে। বেশি না, একমুঠ। প্রতিদিন একমুঠ বাদাম খান। যে একমুঠের ভিতরে থাকবে-
- ✠ কাঠবাদাম- পাঁচটি
- ✠ আখরোট- দুইটি
- ✠ কাজুবাদাম- চারটি
- ✠ পেস্তাবাদাম- চারটি এবং
- ✠ চীনাবাদাম- ১০ থেকে ১৫টি।
কীভাবে খাবেন?
বাদাম ভেজে খেতে অনেক টেস্ট।
রোস্টেড বাদাম দারুন টেস্ট। কারণ ওগুলোতে লবণ থাকে, ভাজা থাকে। পুষ্টিগুণ হারিয়ে যায়। যখনই তাকে ভাজলেন এবং লবণ সম্পৃক্ত করলেন।
ঠিক আছে, মাঝে মধ্যে কালেভদ্রে খান টেস্টের জন্যে।
কিন্তু প্রত্যেকদিন নিয়মিত যে পদ্ধতিতে খাবেন সেটি হচ্ছে রাত্রে একমুঠ বাদাম যেভাবে বললাম এবং সাথে কিছু বীজ ভিজিয়ে রাখেন। আট-দশ ঘন্টা ভিজান।
সকালবেলা ভালো করে ধুয়ে ঐ পানিগুলো ফেলে দিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে দুই তিনটা খেজুর দিয়ে খেয়ে নেন।
পৃথিবীর এক নম্বর খাওয়া মধ্য দিয়ে আপনার দিন শুরু হলো।
অসুস্থ হওয়া কঠিন হবে আপনার জন্যে। খুব কঠিন হয়ে যাবে অসুস্থ হওয়া।
বাদাম যে যে রোগ প্রতিরোধ করে
আপনি যখন নিয়মিত বাদাম খাবেন, তখন আপনি এই রোগগুলো প্রতিরোধ করতে পারবেন-
- ★ হৃদরোগ
- ★ উচ্চ রক্তচাপ
- ★ হার্ট অ্যাটাক
- ★ স্ট্রোক
- ★ ডায়াবেটিস এবং
- ★ রক্তের উচ্চ কোলেস্টেরল।
এছাড়া নিয়মিত বাদামে আপনার উপকারী কোলেস্টেরল বা ভাল কোলেস্টেরল (HDL Cholesterol) আস্তে আস্তে আস্তে বাড়তির দিকে যেতে থাকবে- যা আপনাকে সুস্থ রাখবে।
আর ক্ষতিকর কোলেস্টেরল, এলডিএল কোলেস্টেরল (LDL Cholesterol) কমতে থাকবে। কমলে আপনি সুস্থ থাকবেন।
শেষকথা
তাই আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি যে- ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের বর্তমান সময়ের আবিষ্কৃত বিশ্বের এক নম্বর খাবার বাদাম। এটা অবশ্যই প্রতিদিন আপনার খাদ্য তালিকায় আপনি সংযুক্ত করুন। ধীরে ধীরে ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে আপনি সুস্থ কর্মময় দীর্ঘ জীবনের অধিকারী হবেন।
আপনাদের সুস্থ ও আনন্দময় জীবন কামনা করছি।
☘ পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
☘ কমেন্ট করুন প্লিজ, আপনার কমেন্ট এপ্রিশিয়েট করা হবে।