আমরা অনেকেই জিনিসটাকে ইসবগুলের ভুসি হিসাবেই চিনি। কিন্তু এটি যে ইসবগুল নামক এক ধরনের শস্য থেকে উৎপাদিত, সেটা অনেকেই জানিনা। ইসবগুল নামক শস্যদানাকে মেশিনে গুড়ো করে ইসবগুলের ভুসি তৈরি করা হয়।

ইসবগুলের ভুসির ইংরেজি নাম Psyllium husk এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম Plantago ovata। এটি একটি ভেষজ ঔষধ (Herbal medicine)।
আমরা ইসবগুলের ভুসিকে সাধারনত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যবহার করি এবং এভাবেই এটাকে চিনি। কিন্তু ইসবগুলের ভুসির আছে বেশ কিছু ভেষজ গুন এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ছাড়াও এটি অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় প্রাকৃতিক রোগ নিয়াময়কারী (Natural remedy) হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ইসবগুলের ভুসি এখন ডাক্তাররাও প্রেস্ক্রিপশনে লিখে থাকেন এবং বিভিন্ন ব্রান্ডের বিভিন্ন নামে ফার্মেসিতে পাওয়া যায় ইসবগুলের ভুসি।
এই পোস্টে আমরা ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার উপকারিতা, কিভাবে কতটুকু খাওয়া উপকারিতা আর কিভাবে খেলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারন হবে ইত্যাদি সকল বিষয়ই ফোকাস করব, ইনশাল্লাহ।
ইসবগুলের ভুসির স্বাস্থ্য উপকারিতা
আমরা জানি, ইসবগুলের ভুসি সচরাচর কোষ্ঠকাঠিন্য সারাতেই ব্যবহৃত হয়। কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় ছাড়াও ইসবগুলের ভুসি আরো যে যে রোগ ও শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, তা একনজরে দেখে নিন-
- ✅ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার মাধ্যমে পাইলস বা অর্শ রোগ এবং গেজ রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।
- ✅ হযম শক্তিকে উন্নত করে।
- ✅ কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে।
- ✅ হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
- ✅ ওজন নিয়ন্ত্রন করে।
- ✅ ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
- ✅ ডায়রিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
ইসবগুলের ভুসির পুষ্টি উপাদান
ইসবগুলের ভুসিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরেনের পুষ্টি উপাদান। ইসবগুলের ভুসির প্রধান পুষ্টি হল দ্রবণীয় ফাইবার, যা আমাদের খাদ্য হযম প্রক্রিয়ার শুরু থেকে পায়খানা পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে সাহায্য করে। ফলে পায়খানা শক্ত হওয়ার সুযোগ পায়না।
ফাইবার সহ ইসবগুলের ভুসি তে আরো যে যে পুষ্টি আছে, চলুন এক নজরে দেখে নিই।
১ টেবিল চামচ (১৫ মি. লি.) ইসবগুলে আছে-
- ফাইবারঃ পর্যাপ্ত পরিমানে।
- ক্যালোরিঃ ৫৩ শতাংশ
- সোডিয়ামঃ ১৫ মিলিগ্রাম
- শর্করাঃ ১৫ গ্রাম
- ক্যালসিয়ামঃ ৩০ মিলিগ্রাম
- আয়রনঃ ০.৯ মিলিগ্রাম
- ফ্যাটঃ কোনো ফ্যাট থাকে না।
ইসবগুলের ভুসি কিভাবে কাজ করে
ইসবগুল একধরনের ডায়েটারি ফাইবার বা তন্তু। যার কিছু অংশ পানিতে দ্রবীভূত হয়, কিছু দ্রবীভূত হয়না। খাদ্য হযম প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্ত্র (Gut) এর ভেতরে থাকাকালে ইসবগুলের ভুসি প্রচুর পানি শোষণ করে। আর এভাবে খাদ্যের পাচ্য অপাচ্য অংশকে নরম রাখে। এটা সম্পূর্ণ হযম প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো কিছুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে বিষক্রিয়া তৈরি করে না।
যেহেতু ইসবগুলের ভুসির সঠিক কার্যকারিতার জন্য অন্ত্র থেকে পানি শোষণ জরুরী, তাই ইসবগুলকে দীর্ঘক্ষণ ভিজিয়ে রাখলে বাইরে থেকেই সম্ভাব্য সব পানি শোষণ করে নেবে আর এভাবে এর কার্যকারিতাও কমে যাবে। তাই নিয়মমাফিক ইসবগুল পাত্রে ভিজিয়ে সাথে সাথেই খেয়ে ফেলতে হবে। আর এভাবেই সবটুকু উপকারিতা পাওয়া যাবে।
আসুন এই স্টেপে আমরা ইসবগুলের ভুসির সবচেয়ে বহুল ব্যবহার- কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় করা- এই সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জেনে নিই।
কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসায় ইসবগুলের ভুসি
তথ্যসূত্রঃ ডা. তাসনিম জারা- যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজের একজন চিকিৎসক ও “সহায় হেলথ”-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা।
যারা বছরের পর বছর ধরে পাইলস বা অর্শ কিংবা গেজ রোগে ভুগছেন তারাই এর কষ্টের কথা জানেন। এই রোগগুলোর সূচনা কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে। তাই এই রোগগুলোর চিকিৎসায় সবার আগে প্রয়োজন কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা। পায়খানা নরম বা নরম থাকলে এসব রোগের সমস্যা যেমন কমে যায়, তেমনি মূল চিকিৎসাও সহজ হয়ে যায়।
পায়খানা নরম করার মাধ্যমে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে অর্শ বা গেজ চিকিৎসার অনুকুল পরিবেশ তৈরির একটি কার্যকরী ঔষধ হলো ইসবগুলের ভুসি।
এছাড়াও যাদের এই ধরনের রোগ নেই কিন্তু কোষ্ঠকাঠিন্যে কষ্ট পাচ্ছেন, তাদের জন্য ইসবগুলের ভুসি হতে পারে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা ও সমাধান।
বাজারে খোলা বা প্যাকেটজাত অবস্থায় ইসবগুলের ভুসি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় ফার্মেসিতেও। প্যাকেটজাত হলে, প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমাণমত পানি নিয়ে তাতে ইসবগুলের ভুসি ভালোভাবে গুলে নিয়ে খেয়ে নিতে হবে। এতে শরবতটি হবে পরিষ্কার বা হালকা ঘোলা ঘনত্বের।
এতে অতিরিক্ত চিনি মিশিয়ে খাওয়া কোন শর্ত নয়, বরং চিনি না মেশানোই ভাল। এছাড়া এটি বানানোর কিছু সময় রেখে দিয়ে খাওয়াও ঠিক নয়। এতে এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাবে। শরবত তৈরির সাথে সাথেই খেয়ে ফেলতে হবে।
➤ কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার নিয়ম
- ☪ সাধারণত কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে দিনে দুইবার ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
- ☪ খালিপেটে নয়, যে কোনো দুইবেলা খাবার খাওয়ার পর ইসবগুলের ভুসি খাওয়া সবচেয়ে উত্তম।
- ☪ সাধারনভাবে ১-২ চামচ ইসবগুল ২৪০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেতে হবে।
- ☪ ইসবগুল কতটুকু খেতে হবে, তা অনেকাংশে বয়স, ওজন, শারীরিক অন্যান্য সুস্থতা-অসুস্থতার ওপর নির্ভর করে।
➤ সতর্কতা
মনে রাখবেন, ইসবগুলের ভুসি খেলে সারাদিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে। ইসবগুলের ভুসি খেয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি না খাওয়ার ফলে গলনালি এবং অন্ত্রের মুখ আটকে যায়, অর্থাৎ পরিপাকতন্ত্রে খাবারের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে।
ইসবগুলের ভুসি কখন খাওয়া যাবে না?
৭টি বিশেষ অবস্থা আছে যখন ইসবগুলের ভুসি খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। দেখে নিন একনজরে-
- ☀ ঘুমানোর ঠিক আগ মুহুর্তে ইসবগুলের ভুসি খাওয়া সঠিক সময় নয়। এতে করে ঘুমের সময় বৃহদান্ত্র (Large Intestine) বা মোটা নল, যে অংশে মল তৈরি হয়- সেটার মুখে ভুসি জমে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। Medical Science এর ভাষায় একে বলা হয় অবস্ট্রাকশন (Obstruction)।
‘অবস্ট্রাকশন’ একটি জরুরী স্বাস্থ্য অবস্থা বা জটিলতা। অবস্ট্রাকশন হলে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হবে। এর আগে যদি আপনি কখনও এমনট পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকেন, তাহলে ইসবগুলের ভুসি খাবেন না। - ☀ কোনো কারণে পেটেব্যথা হলে বা বমিবমি ভাব হলে বা বমি হলে।
- ☀ পূর্বে কখনও ইসবগুলের ভুসি খেয়ে শরীরে কোনো ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া (Reaction) এর ইতিহাস থাকলে।
- ☀ কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে দীর্ঘদিন যদি আপনার পায়ুপথের মুখে পায়খানা জমে আটকে থাকে।
- ☀ মলত্যাগের সময়, পরিমাণ, ধরণ বা অভ্যাসে যদি হঠাৎ কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে এবং তা যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয়।
- ☀ আগে থেকেই যদি পায়ুপথ দিয়ে রক্ত যায়, যার কারণটা এখনও ধরা পড়েনি।
- ☀ যদি বৃহদান্ত্রের মাংসপেশির দুর্বলতা (Colonic Atony) জনিত বা ধীরগতি জনিত কোনো রোগের ইতিহাস থাকে।
বিঃদ্রঃ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া একটানা দীর্ঘদিন ইসবগুলের ভুসি খাওয়া ঠিক পদ্ধতি নয়। এতে ডায়রিয়া ও অন্যান্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। একটানা ৩ দিন ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার পরও যদি কোষ্ঠকাঠিন্যের উন্নতি না হয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
তথ্যসূত্রঃ প্রথম আলো
➤ ডায়রিয়া চিকিৎসায় ইসবগুল
খাওয়ার পর ২ চামচ ইসবগুলের ভুসি ৩ চামচ দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।এখানে দই প্রোবায়োটিক হিসেবে কাজ করবে।
প্রতিদিন এই নিয়মে ইসবগুলের ভুসি সেবন করলে পায়খানা নরম হওয়ার বদলে শক্ত হবে।
ডায়রিয়ার কারন-যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরা্সের দ্বারা খাদ্যনালির ক্ষতিসাধন-সেটা ইসবগুলের ভুসি সারিয়ে তোলে।
➤ দীর্ঘদিন হজমের সমস্যায় ইসবগুলের ব্যবহার
ইসবগুল পাকস্থলী পরিষ্কার রাখার মাধ্যমে হযম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। প্রতিদিন ২ চামচ ইসবগুল ২৪০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে খেয়ে ফেললে পাকস্থলি পরিস্কার হবে। করে।
ইসবগুলের ভুসি খাদ্যনালি রাখে টক্সিনমুক্ত (Toxin free)। এটা ক্ষতিকর পদার্থ শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে।
➤ অর্শ্বরোগ নিরাময়ে ইসবগুল
অর্শ্বরোগ নিরাময়ের জন্য ২ চামচ ইসবগুল কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলতে হবে।
এটি পায়খানায় পানির পরিমাণ বাড়ায় ও নরম করে রাখে, ফলে পায়খানার সময় ব্যথা লাগে না।
পায়খানা নরমের ফলে বৃহদন্ত্রের উপর চাপ কম পড়ে এবং কম রক্ত যায়।
➤ বুক জ্বালাপোড়া বা গ্যাসের সমস্যায় ইসবগুল
বুক জ্বালাপোড়া বা এসিডিটি হলে ২ চামচ ইসবগুল ১/২-১ চামচ ঠান্ডা দুধে মিশিয়ে খেতে হবে।
দুধ ও ইসবগুল অ্যাসিডকে প্রশমিত করে।
ইসবগুল পাকস্থলী ও খাদ্যনালির ভেতরে আলাদা একটি পর্দা তৈরি করে, যা অ্যাসিড থেকে খাদ্যনালীর পর্দাকে রক্ষা। আর এভাবে বুক জ্বালাপোড়া কমায়।
➤ ওজন কমাতে ইসবগুলের ভূমিকা
ওজন কমানোর জন্য ২ চামচ ইসবগুল ২৪০ মিলিলিটার পানি ও ১-২ চামচ লেবুর রস দিয়ে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেতে হবে। এতে বেশ খানিকক্ষণ পেট ভরা থাকে।
ইসবগুল খাদ্যনালি পরিষ্কার করে ও শরীরে চর্বি কমায়।
➤ হৃদ্রোগ নিরাময়ে ইসবগুল
প্রতিদিন খাবারের পর ইসবগুল খেলে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমতে থাকে।
➤ ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইসবগুল
১-২ চামচ ইসবগুল ২৪০ মিলি পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে।
এ জন্য ডায়াবেটিস রোগীদের ইসবগুল সেবনের সময় সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগীরা দইয়ের সঙ্গে ইসবগুল সেবন থেকে দূরে থাকবেন।
শেষকথা
একাধারে দীর্ঘদিন ধরে ইসবগুলের ভুসি খেয়ে যাওয়া ঠিক নয়। নিজের শরীরের ভাষাও বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
☘ পোস্টটি শেয়ার করে দিন।
☘ কমেন্ট করুন প্লিজ, আপনার কমেন্ট এপ্রিশিয়েট করা হবে।